বগালেক-কেওক্রাডং ২০২১ (পর্ব-১)
16th November, 2021
একখান মনের মতো জায়গায় মনের মতো মূহুর্ত কাটাইতে ভাগ্যও লাগে। শীতের শহরে যখন টানা তিনদিন বৃষ্টি হলো, ধরে নিসিলাম এইবারের ট্যুর এত এত প্ল্যানিং সব শেষ। ঠিক যাবার আগেরদিন দিনটায় হালকা রোদ এসে সবকিছু ঠিক করে দিল। কয়েকটা দিন আগেও যে ট্যুর হবার কথাই ছিল না, ১৬ তারিখ রাতে দেখলাম সবাই শ্যামলীর কাউন্টারে। আমরা টোটাল ছিলাম ১২ জন। আমি, রেশাদ, প্রান্ত, আশিক, সৌরভ, তালহা, আলিম, আবির, রেজোয়ান, রেশাদের বন্ধু আলিফ, প্রান্তর বন্ধু আবির আর তার ভাই সাব্বির। ঠিক বাসে উঠার ২০ মিনিট আগে আশিকের বাসা থেকে ফোন এলো, আঙ্কেল অসুস্থ, বুকে ব্যথা! আশিক তো তখনই চলে যায় এমন অবস্থা। অবশেষে কিছুক্ষণ পরে আঙ্কেলই বললেন উনি আগের চেয়ে সুস্থ, হাঁটাহাঁটি করতে পারছেন। পরে আর কি। বাস চলে এলো, আমরাও রওনা হলাম অচেনা এক উদ্দেশ্যে।
যেতে যেতে পথে
17th November, 2021
আমি যখন এই কাহিনী লেখছি, তখন আমার চারপাশে শহরের অসংখ্য গাড়ি হর্ণ বাজিয়ে হাতিরঝিলের পথে ছুটে চলেছে। অথচ কয়েকঘন্টা আগেও আমি ছিলাম এক বুনো জঙ্গলে, যেখানে গাছে গাছে ফুল, অসংখ্য প্রজাপতি, মাকড়সা আর ছোট ছোট ঝিরি বয়ে চলেছে পাহাড় বেয়ে। যাই হোক, ফিরে আসি।
সামনের সীট নেওয়ার কারণে সারারাত ঘুম হয় নাই। ভোরের আলো ফোঁটার পরে দেখলাম দূরে পাহাড়, অসংখ্য পাখি একটু পরে পরে উড়ে যাচ্ছে, সে এক অদ্ভূত দৃশ্য। পথে একবার আর্মি পোস্টে এনআইডি চেকিং হলো। সাপের মতো আঁকাবাঁকা আর উঁচু নিচু পাহাড়ি রাস্তা হয়ে ভোর ছয়টায় গিয়ে বাস পৌঁছালো বান্দরবানে। আমাদের গাইড আর চান্দের গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা। গাইড ইলিয়াস ভাই উঠবেন রূমা বাজার থেকে, আর চান্দের গাড়ি থাকবে শহরেই। আমরা শহরে কিছুদূর হেঁটে ফোন দিলাম ড্রাইভারকে। উনি এসে আমাদের নিয়ে গেলেন এক হোটেলে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে আমরা চলে এলাম ব্রীজের কাছে। নিচে তখন খরস্রোতা সাঙ্গু নদীর বর্ষাকালীন শুষ্ক রূপ। সেখানে কিছু ছবি তুলে আমরা সওয়ার হলাম চান্দের গাড়িতে। আর তারপর?
এই সেই সাঙ্গু
আমরা
গল্পের এই পর্যায়ে আমাদের গাইড ইলিয়াস ভাইয়ের আগমন।
রোলার কোস্টার ভাই, রোলার কোস্টার। এই নামে এই উঠে। ছোটখাটো পাহাড় দেখে অভ্যাস বলে বড় পাহাড়ি কি জিনিস সেইটা তখন প্রথম টের পাইলাম। কখনো বামে পাহাড় ডানে খাদ, কখনো নদী, কখনো দুইপাশেই পাহাড়। এমন খাড়া রাস্তায় উঠানামা করে, মনে হয় ব্রেকফেল করলে শেষ। আমরা কয়েকজন তো বলতে গেলে দাঁড়িয়েই গেলাম গাড়িতে। মাঝে একটা ভিউপয়েন্টে নামানো হলো যেখানে সাইনইন করা লাগে। সেই প্রথম দেখলাম পাহাড়ের অসম্ভব সুন্দর রূপ। বহুদূরে সাঙ্গুর একটা অংশ বয়ে চলেছে, আর চারপাশে উঁচু নিচু পাহাড়, নীল সাদা আকাশে সূর্যের আলোয় কেমন যেন অপার্থিব লাগছে সবকিছু। সবার তখন ছবি তুলার হিড়িক পড়ে গেল।
ভিউপয়েন্টে
রূমা বাজার যাওয়ার আগে আরো কয়েকবার থামতে হলো টুরিস্ট সাইনইন করার জন্য। সবচেয়ে বেশিক্ষণ থামা লাগল রূমা বাজার যাওয়ার ১৫ মিনিট আগে, আর্মি পোস্টে(Tourist Assistant Center), সেখানে টুরিস্টদের সব ডিটেলস লিখে সিগনেচার করা লাগে। ঠিক এই ডিটেলসগুলাই পরবর্তী সবগুলো পোস্টে, এমনকি কেওক্রাডংএও পাস করে দেওয়া হয়। সবকিছু শেষ হলে আবারও সেই উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম রূমা বাজারে, তখন আনুমানিক ১১ টার কাছাকাছি বাজে। গল্পের এই পর্যায়ে আমাদের গাইড ইলিয়াস ভাইয়ের আগমন।
ইলিয়াস ভাই, সহজ সরল হাসিখুশী এক মানুষ, বয়স ৩০ এর দিকে। উনার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়ায়। ২০১১ সালের পর থেকে উনি গাইডের কাজ করেন। উনার রুটপারমিট এই বগালেক আর ক্রেওক্রাডং। উনি আমাদের কতটুকু সাহায্য করেছেন সেই গল্প যথাসময়ে আসবে।
গাড়ি রূমা বাজারে থামলে আমরা বাজার করতে নামলাম। যেহেতু আমাদের বগালেকে বারবিকিউ করার প্ল্যান ছিল, সেই সরঞ্জাম থেকে শুরু করে অনেকের মাথার হ্যাট, ট্রেকিং স্যান্ডেল এগুলা কেনার দরকার ছিল৷ সবাই যখন দোকানে দোকানে ঘুরছি, একটু পরে ইলিয়াস ভাই এসে হাজির।
জলপ্রপাতটা দেখাও হয়ে যাবে!
বারবিকিউ এর মুরগী কেনার জন্য ইলিয়াস ভাইয়ের সাথে আমি রেশাদ দোকানে গেলাম। মুরগী নেওয়ার পর ইলিয়াস ভাই এক নতুন জিনিসের কথা বললেন যা আমাদের প্ল্যানেই ছিল না। ঋজুক ঝর্ণা। আমাদের প্ল্যান ছিল বগালেকে এক রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে আমরা কেওক্রাডংএর উদ্দেশ্যে রওনা হবো। পথে চিংড়ি ঝর্ণা দেখব। আর সেইদিন কেওক্রাডং এ কাটিয়ে পরদিন সকালে ব্যাক। যদি কপাল খুব বেশি ভালো থাকে তাহলে জাদুপাইয়ে যাওয়াও হতে পারে। সুতরাং ঋজুক ঝর্ণার কথা আমাদের মাথায়ই ছিল না। ইলিয়াস ভাই বললেন রূমা বাজার থেকে একটু দূরে গিয়ে নৌকায় করে সাঙ্গু নদী হয়ে ঋজুক ঝর্ণায় যাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্র দেড় ঘন্টা খরচ হবে আর নৌকার ভাড়াটা যাবে। আমরা তো শুনেই রাজি। সাঙ্গু নদীর বুকে আরোহণও হয়ে যাবে, সাথে সাথে জলপ্রপাতটা দেখাও হয়ে যাবে!
কিন্তু সমস্যা দাঁড়ালো বাকিদের নিয়ে। সবাই যেতে চাইলো না। তাদের জন্য কষ্ট হয়ে যাবে যাওয়া। শেষপর্যন্ত সেখানে গিয়ে দুইজন গাড়িতে থাকলো, আর আমরা বাকি ১০ জন নৌকায় বসে পড়লাম।
ঋজুকের পথে
পেছনে পাহাড়, সামনে পাহাড়, দুই পাশে জুম চাষের জমি আর তার মাঝে বয়ে চলা নদী সাঙ্গু। নীল আকাশ আর সাদা মেঘের মাঝে আমাদের বয়ে চলা। জীবন কতখানি সুন্দর ছিল সেই সময়টায়। চারিদিকে সবকিছু শুধু স্বপ্নময় ছিল। কত অপরূপ রূপ লাবণ্যে ভরা আমাদের দেশ ভাই। সেই সময়টা, ঠিক সেই সময়টায় বাস করার জন্য সবকিছুই করা সম্ভব। দুইপাশের ছোট সারিসারি পাহাড় পার হতে হতে হঠাৎ দেখি ডানপাশে পানির স্রোতধারা পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসছে, এই সেই ঋজুক।
নৌকা থামাতেই নেমে পড়লাম আমরা। কী অসাধারণ মূহুর্ত।শুভ্র শীতল জল নেমে আসছে পাহাড়ের বুক বয়ে, একপাশে তাই মিশে যাচ্ছে সাঙ্গু নদীর বুকে। কেউ আর তর সইতে পারলাম না আমরা। হুড়োহুড়ি করে কাপড়চোপড় বদলে তখনই ঝর্ণার নিচে আমরা। রেজোয়ান, তালহা আর ইলিয়াস ভাই থাকলেন ঝর্ণার অপর পাড়ে। সেই ঝর্ণার নিচে আবার টেক্সটাইলের তুষার ভাই আর রাকিব ভাইয়ের দলের সাথে দেখা। উনাদের শেষ ব্যাচ ট্যুরের শেষ দিন ঋজুকেই। উনারা গেলে আমরা ঝর্ণার নিচে দাঁড়ালাম। দাঁড়াব কি, সূচের মতো ঠান্ডা জল শরীরে বিঁধে যাইতেসে। এত তীব্র জলধারায় শ্বাস নেওয়াই দায়। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না, নিচে নেমে আসলাম। আস্তে আস্তে গা সয়ে এলো। তারপর আর কি, কিছুক্ষণ থেকে আমরা চলে আসলাম। কাপড় পড়তে যাব দেখি রেশাদ সাঙ্গুতে নেমে গেসে। একদম মাঝে দাঁড়িয়ে আছে অথচ হাঁটু সমান পানিও নেই। দেখাদেখি আমরাও একেএকে নেমে পড়লাম। একপাশে সূর্যের স্নিগ্ধ আলো, অন্য পাশে নদীর বাঁক, দুই পাশে পাহাড় আর ঝর্ণা, পায়ের নিচে সাঙ্গু আর নরম বালি আর মাথার উপরে নীলাকাশ! আহারে জীবন।
ঝর্ণার ধারে দুইটা কুকুর ছিল, এরমধ্যে সাদা রংএরটা ছিল অস্থির, ডাকলেই চলে আসে আদর নিতে। আসার সময় দেখলাম সেইটা জলপ্রপাতের দিকে তাকিয়ে আছে, আশেপাশে কেউ নাই, অদ্ভূত দৃশ্য। আবারও সেই নৌকা করে চলে এলাম আমরা ঘাটে। তারপর কাপড় বদলে চান্দের গাড়িতে। অতঃপর যাত্রা।
আমরা যখন বগালেকে পৌঁছাই ততক্ষণে দুপুর দুইটা পার হয়ে গেছে। শান্ত স্বচ্ছ জলের বগালেকের চারপাশে তখন পরিষ্কার দেখা যায়। গাড়ি থামলো ঠিক আমাদের কটেজের সামনে। এখানেই ইলিয়াস ভাইয়ের কেরামতি। কটেজটা আর্মিদের। আশেপাশের কটেজগুলোর মধ্যে শুধু এইটাতেই কারেন্ট আছে। দুই রূমের কটেজের প্রত্যেকটাতে সাতজনের ম্যাট্রেস করা সীট, পেছনে তিনটা টয়লেট যেটার একটাতে কমোডও আছে। পরিপাটি ছিমছাম কটেজটা আবার বগালেকের পাড়েই। সবাই নিজ নিজ জায়গা বুঝে নিয়ে কটেজের একটু দূরে এক বাড়িতে দুপুরের খাবার খেলাম। অস্থির লাগলো, একদম বাসার খাবারের মতো রান্না এতই স্বাদ।
তারপর আর কি। একটু রেস্ট নিয়ে অল্পবিস্তর হাঁটাহাঁটি। আমি রেশাদ আলিফ হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার শেষ মাথায় চলে গেলাম যেখান থেকে পাহাড়ের শুরু। বিশাল অরণ্য তিনপাশে। একটু পরেই অদ্ভূত ঘটনা ঘটলো। হঠাৎ দেখলাম বিশাল চাঁদ উঠলো পাহাড়ের এক কোণে। অপার্থিব এক দৃশ্য। এমন দৃশ্য কেবল আরণ্যকে পড়েছিলাম। বাম পাশে অল্প দূরে দূরে বড় জালে মাকড়সা। ঝিঁঝিঁ ডাকছে, একটু দূরে দূরে তক্ষকও ডাকছে, আর অজস্র ছোট ছোট লাল রংএর ফুল ফুটে আছে। দুইদিন পরেই পূর্ণিমা, তারপরেও সেই জ্যোৎস্নার আলো কোনো অংশেই কম ছিল না। দেখতে দেখতে কটেজে ফিরে এলাম আমরা। সোলার চালু হয়ে গেছে ততক্ষণে। ফোন চার্জে দিয়ে আমরা কটেজের দুই ছাউনির একটাতে বসে পড়লাম। রেশাদ উকুলেলে নিয়ে আসলো। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেল গান। রেশাদের গান শুনে ততক্ষণে ভীড় জমে গেছে। সবার পছন্দমতো গান গাইতে গাইতে একসময় বেশ রাত হয়ে গেল। বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলাম, আড্ডা দিলাম।
এই সেই চাঁদ
বারবিকিউ
ততক্ষণে ইলিয়াস ভাই একাই বারবিকিউ করে ফেলেছেন। খাওয়ার ডাক পড়লো। আবার বের হলাম আমরা, তখন ১০ টার কাছাকাছি বাজে। পরোটা, সালাদা আর বারবিকিউএর মুরগী খেলাম। অস্থির রাঁধসেন ভাই। খাওয়া শেষ হলে বাইরে কিছুক্ষণ বসলাম। চাঁদ তখন সর্বগ্রাসী রূপ নিয়ে পুরো আকাশ আলো করে রেখেছে। বামে দূরে সেভেন সিস্টার্স আর ডানে একটু নিচে অরিয়ন। রেশাদ দেখি শুয়ে পড়েছে রাস্তার পাশে, আমারে বললো শুয়ে চাঁদ দেখতে। দুইজনই দুইপাশে শুয়ে চাঁদ দেখতেসি আর এডভার্বের কে তোমাকে গান বাজতেসে। পাশে বগালেক আর ঠান্ডা হিমেল হাওয়া। মাতাল করা পরিবেশ।
কটেজে এসে বিছানা রেডি করে সারাদিনের হিসাবনিকাশ শেষ করলাম। তারপর পরেরদিন ভোরে উঠার জন্য দিলাম সবাই ঘুম। লং ডে এহেড।
25th November, 2021